সাইট ডাউন

অগাষ্ট 4, 2016

অনিবার্য কারনে আগামী দুদিন সাইটটি বন্ধ থাকবে। আমরা আন্তরিকভাবে দু:খিত।


ভাওয়াইয়া: প্রভাব, প্রেক্ষিত, উত্তোরন ও পথপরিক্রমা

অগাষ্ট 3, 2016
[জোবায়ের আলী জুয়েল][মাশিয়াত খান]
সংকলন: ওয়েব কে টীম।
উত্তর জনপদ ভাওয়াইয়া গানের প্রাণকেন্দ্র। ভাওয়াইয়া দেশের উত্তর জনপদের একটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত হিসেবে স্বমহিমা ও ঐতিহ্যের পরাকাষ্টা দেখিয়ে আসছে। উত্তরবাংলা বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর এবং কুচবিহারের সঙ্গীত পিপাশুদের কাছে এর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। ভাওয়াইয়ার কথা, সুর, তাল, লয়ে মুগ্ধ উত্তর জনপদের মানুষ ভাওয়াইয়াকে অতি আপন করে নিয়েছে। তবে ধ্রুবসত্য এই যে, ভাওয়াইয়া সঙ্গীত তার উত্তরযুগ এবং এই সেদিন পর্যন্তও গুনীজনদের দরবারে অপাঙ্গতেয় ছিল। রাজার আনুকূল্য এ সঙ্গীত পায়নি। সহজাত সঙ্গীতের যে মর্যাদা পাওয়ার কথা তাও পায়নি।
কন্টকাকীর্ণ পদযাত্রায় ভাওয়াইয়া:

অধ্যাপক হিতেন নাগ অবশ্য এর কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে দেখিয়েছেন। তার মতে, ভাওয়াইয়া গান চতুর্দশ দশকে বা তার পূর্বে প্রতিষ্ঠিত। সে সময়ে হিন্দুসমাজে বর্ণবাদ প্রকট ছিল। আর ভাওয়াইয়া গান ছিল গোচারণ ক্লান্ত রাখাল বালক, যূথবদ্ধ মোষের পালের মঈষাল বন্ধু, হাল কর্ষনরত চাষী, যুবকের কন্ঠে স্বচরিত গান। বর্ণাশ্রম শাসিত হিন্দু সমাজের একেবারে নীচু তলার মানুষজন অর্থাত ব্রাতজনের গাওয়া ভাওয়াইয়া সঙ্গীত যত ভালোই হোক না কেন, এ গান সহজে জাতে ওঠেনি। উঠতে দেওয়া হয়নি। সমাজের মাথায় যাদের অবস্থান তাদের কাছে রাখাল বালক, হালুয়া চাষীর কোন মূল্য নেই। তাদের সাথে উঁচুশ্রেণীর আথিতেয়তা অসম্ভব। আর তাদের গান? সে তো ফেলানী। অনিবার্য কারই আর্থ-সামাজিক অবস্থার কোপটা পড়ে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের উপর। এ সঙ্গীত বেড়ে ওঠে বেড়ার ধারে লাউগাছটার মত। গরুর পাল যতবার মাড়িয়ে দিয়ে যায় ততবারই সে ফুঁপিয়ে বেড়ে ওঠে। নধর নধর চেহারায় পল্লবিত হয়ে আরও সুন্দর হয়।

রাজানুগ্রহের কার্পণ্যে, সমাজপতিদের উন্নাসিকতায়, কুলীন শিল্পীদের অহংকারে কীভাবে এ গান মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়? তাই অবজ্ঞাই তার প্রাপ্য। কিন্তু এই  ভাওয়াইয়া সঙ্গীত জনসম্মুক্ষে আসে শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের হাত ধরে (সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল আব্বাসী, শিল্পী ফেরদৌসী আরা ও মুস্তফা জামান আব্বাসী- এর জনক এবং ড: নাশিদ কামালের পিতামহ শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ।)।

উত্তরণ ও চর্চায় ভাওয়াইয়া:

১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত কাউন্সিল একে মৌখিকভাবে সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের ফসল বলে অভিহিত করে। কোচবিহারের হরিশচন্দ্র পালের পরিশ্রমে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের দু’টি মূল্যবান সংকলন পাওয়া যায়। পূর্বে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের তেমন কোন আনুষ্ঠানিক চর্চা না থাকলেও শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের পরবর্তী সময়ে এর গ্রহনযোগ্যতা এবং চর্চা দুইই বৃদ্ধি পায়।বর্তমানে রংপুর ও ঢাকায় ভাওয়াইয়া অঙ্গন আছে, রংপুরে ভাওয়াইয়া একাডেমী এবং ভাওয়াইয়া পরিষদ রয়েছে। ভাওয়াইয়া পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা ও রংপুরে ভাওয়াইয়া ভবন নির্মাণের আবেদন করা হয়েছে এবং রংপুরে এর ভিত্তিপ্রস্থও স্থাপিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ভাওয়াইয়া চর্চা শুরু হলেও ভাওয়াইয়া গান এখনো তথাকথিত ভদ্র সমাজে প্রাপ্য গ্রহনযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।

উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট:
ভাওয়াইয়া গানের সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হলেও এই গানের মূল পরিচিতিই এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। ভাওয়াইয়া গানে মূখ্য হল প্রেম। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘ইহার মধ্য দিয়া প্রধানতঃ প্রেম স্প্ররশকাতর নারী মনের বিচ্ছেদ বেদনার ভাবই অভিব্যক্তি লাভ করিয়া থাকে। ইহার প্রধান সুর বিরহ কংবা অতৃপ্তির সুর’। যদিও অনেকে একে গণমানুষের গান বলে উল্লেখ করে তথাপি দেখা যায় এই গানে গণ মানুষ হিসেবে যেসব নার-নারী স্থান পায় তারা কোন না কোন সম্পর্ক সুত্রে বাধা। তবে শুধু যে বিরহী নারী এই গানে আকুতি জানায় এটি পুরোপুরি সত্য না। এর সাথে মৈষাল বন্ধু ( মহিষ রক্ষণাবেক্ষণকারী রাখাল), মাহুত বন্ধু, কিষাণ বন্ধু, শাশুরী, ননদসহ আরো অনেক চরিত্র ফুটে ওঠে। মনুষ্য চরিত্রের আশাপাশি আছে বক, পায়রা, বিড়াল, কাক, ময়না, মাছ ও অন্যান্য অনেক চরিত্র। তবে এইসব চরিত্রের সাথেই প্রেমের যোগসুত্র রয়েছে। উদাহরণ-অবোধ প্রেমিকের কথা উল্লেখ করে_ ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে, ফান্দ বসাইছে ফান্দিরে ভাইয়া পুটিমাছ দিয়া ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া’। প্রেমিকহীন বিরহী নারীর কষ্টের কথা_‘ও দিদি শোনেন একটা কথা তোক ছাড়া আর কাক শাইকাং, তুই ছাড়া আর কবার জাগা নাই; বাপ মায়ের কপাল পোড়া, সেই জন্যে ভাল পাত্তর আইসে না’। প্রিয় মানুষের মৃত্যুর উল্লেখ_ ‘ওকি একবার আসিয়া, সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়া রে। প্রেমিকের আগমনের উতকন্ঠা_‘মোর কালা খাইবে ভাত, কোনঠে পাইম মুই কলার পাত, কোনঠে পাইম মুই জিয়া মাগুর মাছ’। স্বামীর জন্য আকুতি_‘ও পতিধন আইস, পতিধন বৈসো।

ভাওয়াইয়া: নামকরন:
ভাওয়াইয়া গানের নামকরণ ব্যাপারটা ভয়ানক জটিল। হিতেন নাগের মতে, এর নামকরেণের অবস্থাটা কপালকুন্ডলার নবকুমারের মত। মতামতের অরণ্যে আমরা পথভ্রষ্ঠ এবং বিভ্রান্ত। এক দল বলে, ‘ভাব’ শব্দ থেকে এর উতপত্তি।‘ভাব’ শব্দের প্রচলিত একটা অর্থ প্রেম। অন্য দল বলে, ‘ভাও’ শব্দ থেকে এসেছে ভাওয়াইয়া। ভাও মানে দরদাম। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মনের ঠিকানা, অবস্থা এবং প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছা অনিচ্ছার খোঁজ নেওয়া, মূল্য দেওয়া। অনেকে বলে, ভাওয়াইয়া অর্থ উদাস। ‘মন মোর ভাওয়াইয়া হইসে’। ভাওয়াইয়া গানের উদাস প্রেমিক প্রেমিকার মনোবস্থা থেকেই এর উতপত্তি। কেউ কেউ বলে, ভাওয়াইয়া এর আরেক অর্থ মহিষ চারণ ক্ষেত্র। ভাওয়াইয়া গানে উল্লেখযোগ্যভাবে মৈষাল বন্ধুর কথা বলা হয়েছে। মৈষাল বন্ধুর গান যেহেতু একমাত্র ভাওয়াই গানেই পাওয়া যায় তাই এর থেকে ভাওয়াইয়া নামকরণ এও ধারনা করা হয়। তবে এদের কোনটিই যুক্তিতে টেকেনি। তাই এর নামকরণ নিয়ে সন্দেহের শেষ নেই। তবে নামকরণ যাই হোক। সাহিত্যের দিক থেকে ভাওয়াইয়া গান অনেক সমৃদ্ধ তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারেনা। ভাওয়াইয়া গান বেশ পূর্ব থেকে প্রচলিত তার প্রমাণ এর সাথে বৈষ্বব পদাবলীর সাদৃশ্য। ভাওয়াইয়া শুনলে মনে হবে চন্ডীদাসের পদাবলী শুনছি। চটোকা গানের সাথেও এর অদ্ভুত এক মিল আছে। চটকা গানের মেজাজ কেবল খানিকটা লঘু। তা নাহলে ভাওয়াইয়া আর চটকা একই বলা যেত। ভাওয়াইয়া গানে আছে রাধা-কৃষনের প্রেমের অনিবার্য প্রভাব। একটি গানে আবার সুদূর ময়মনসিনহহের লোকগীতি কেমন করে যেন জায়গা করে নিয়েছে। ‘তুমি ক্যানে মরবেন কন্যাহে কন্যা আমার পরাণ হরি, তুমি হও দরিয়া কন্যা আমি তাতে ডুবে মরি হে’। এ গানটি পুরুষ ও নারীর মধ্যে সংলাপ মুখর। আশ্চর্য ব্যাপার হল ময়মনসিংহ গীতিকায় এরুপ সংলাপের দেখা মেলে। ভাওয়াইয়া গান আর মহুয়া পালা গান মিলেমিশে এক ও অভিন্ন হয়ে উঠেছে। ভাওয়াইয়া অনেকটা বহতা নদীর মত। বিভিন্ন বাঁকে মিশেছে বিভিন্ন ধারার গানের সাথে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত:

উত্তরাঞ্চলের লোক সাহিত্যের উপাদানগুলো সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেন স্যার জর্জ অ্যাব্রাহাম গ্রীয়ারসন। যদিও তিনি ইংরেজ ছিলেন তবুও বাংলাভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ ও ভালবাসা। তিনি ‘মানিক চন্দ্রের গান’ একজন সাধারণ কৃষকের নিকট থেকে সংগ্রহ করেন। ‘জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ পত্রিকায় প্রাঞ্জল ইংরেজিতে অনুবাদসহ প্রকাশ করেন। তার সংগ্রহগুলো প্রকাশিত হবার পরই আমাদের সাহিত্য বিদেশি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রীয়ারসন সম্পাদিত ১৯০৩ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত ‘Linguistic Survey of India’ এর পঞ্চম খন্ডে তিনি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বহু গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা পরবর্তীকালে আববাস উদ্দীন আহমদ কর্তৃক সংগৃহীত গানগুলোতেও পাওয়া গেছে। আজ অবশ্য উত্তরাঞ্চলের লোকঐতিহ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত। আমরা জানি বাংলাদেশে লোকগীতিকা ও লোকসঙ্গীতের যে বিপুল ভান্ডার সঞ্চিত আছে অনেক মনীষীর মতে তা বিশ্ব জয় করতে পারে।

ভাওয়াইয়া: বৈশিষ্ট, বৈশ্বিক প্রভাব, চেতনা ও প্রকাশ:
উত্তরাঞ্চলের লোকসঙ্গীত আলোচনা প্রসঙ্গে এখানকার প্রাকৃতিক এবং অন্যান্য অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের কিছুটা প্রাথমিক ধারণা থাকা আবশ্যক। বৃহত্তর রংপুর জেলার পার্শ্বেই জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলা, পূর্বে আসামের গারো পাহাড় ও পশ্চিমে যমুনা নদী, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা করতোয়া, পূর্ণভবা, ধরলা, সমকা ও দুধকুমার প্রভৃতি নদীর পলি দিয়ে গঠিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মাটি। এই নদীগুলোর নিরন্তর ধারা পরিবর্তন, ধূসর বালুচরের সূচনা ও এখানকার অধিবাসীদের মনকে উদাস করে সৃষ্টি করেছে লোক সাহিত্যের উর্বর পশ্চাদভূমি। নদ-নদীর ঐশ্বর্য্যে চিহ্নিত বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত জেলার লোকসাহিত্য সম্পর্কে এ কথা সর্বজন বিদিত।
এখানকার প্রাথমিক যুগের নৃপতিদের মধ্যে রংপুরের ‘চাকলা বোদা’ নামক স্থানে নৃপতি পৃথ্বিরাজের রাজত্বকালীন স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে। নীলফামারী জেলার ডিমলা নামক স্থানের কিছু দক্ষিণে ধর্মপালের স্মৃতি বিজড়িত অনেক বিষয়াদির অনুসন্ধান পাওয়া গেছে। সাঁওতাল, কোচ, হাজং, রাজবংশী ইত্যাদি উপজাতীয় সংস্কৃতি রসধারায় লোকসঙ্গীতের ভান্ডার পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। উত্তরাঞ্চলের লোকসঙ্গীতের মধ্যে ভাওয়াইয়া গান সমাজের সাধারণ স্তরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাওয়াইয়া গান তথ্য ও ভাবপ্রধান, নর-নারীর প্রেমই এর মূল বিষয়বস্তু। বিরহই প্রেমের সর্বোত্তম অংশ। এর প্রধান ভাবধারা বিরহের কিংবা অতৃপ্তির যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুনতে পাওয়া যায় তা এ গানতে এক অনবদ্য বেদনা মধুর রস রূপ  দিয়েছে। এ ধরনের একটি গানের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি দেয়া হলো-পরথম যৈবনের কালে না হৈল মোর বিয়া, আর কতকাল রহিম ঘরে এককানী হয়া রে বিধি নিদয়া হাইলা পৈল মোর সোনার যৈবন মলেয়ার বাড়ে, মা ও বাপে মোর ইল সাদী না দিল পরের ঘরে রে বিধি নিদয়া। উদ্ধৃত লাইনগুলোর মধ্যে নারী মনের হতাশা ও নিরাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানও এই রিক্ততার বেদনার মধুর হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কাঁচা সোনা ফেলে রেখে যে সওদাগর পোড়া সোনার সন্ধানে দূর দেশে যায়, তার মত মূর্খ আর কে আছে? তার প্রেমেরই বা কি মূল্য। ঘরের কাঁচা সোনা যে চিনলো না, সে বিদেশের পোড়া সোনা চিনবে কি করে? নিরক্ষর কোন অজানা কৃষক কবির রচনায় এই অপূর্ব ভাবটি কি মধুর রসেই না ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। ধন কাঙ্গালী সাউধের ছাইলা রে-আরে মোর ধনক নাই গো মন, ঘরে থুইয়া কাঞ্চা সোনা (ও মোর বন্ধু) বৈদেশে গমন। আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ ভাওয়াইয়া গানও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’, ‘ছাড়রে মন ভবের খেলা’ ইত্যাদি। ‘বাউদিয়া’ নামক উদাসী সম্প্রদায় এ গানের রূপকার। কারও কারও মতে এই ‘বাউদিয়া’ থেকেই ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। ভাওয়াইয়া গান প্রধানত দুই প্রকার- দীর্ঘ সুর বিশিষ্ট ও চটকা সুর বিশিষ্ট। প্রথম শ্রেণীর গানে নর-নারীর বিশেষত: নব যৌবনাদের অনুরাগ-প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার আবেদন ব্যক্ত হয়। এরূপ গানের মধ্যে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’ ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বনদূরে’ ‘নউতন পিরিতের বড় জ্বালা’ ইত্যাদি অধিক জনপ্রিয়। ভাওয়াইয়া গানের অপর অংশের নাম চট্কা গান। গ্রামে চট্ শব্দের অর্থ তাড়াতাড়ি। চট্কা সুরের ভাওয়াইয়া গান খুব দ্রুত লয়ে গাওয়া হয় বলে এ গানগুলোকে আমরা চট্কা নামে অভিহিত করে থাকি। ভাওয়াইয়া গানে গুরুগম্ভীর বিষয় ও দীর্ঘ টানের সুর ব্যবহৃত হয়, লঘু স্তরের বা চট্কদার বিষয় ও ক্ষিপ্রতালে সুর অবলম্বন করে চট্কা গান রচিত হয়। এ শ্রেণীর গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে। চট্কা গানের ভিতর দিয়ে সাধারণত দাম্পত্য জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা মনোমালিন্য, কামনা-বাসনা ও সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের চিত্র প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। ‘ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান’ ‘পানিয়া মর মোক মারিলুরে’ ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি/ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি’ প্রভৃতি গান এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই দুই শ্রেণীর গানের সুরের মিশ্রণে অপর এক শ্রেণীর গানও প্রচলিত, যা ক্ষীরোল গান নামে পরিচিত। যেমন-‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে।’ ‘ কোন-বনে ডাকিলু কোকিলরে।’ মইশের পিঠে চড়ে মইশালরা মাঝে মাঝে মাঠে মইশ চড়াতে আসে, গ্রামের তরুণীগণ কাপড় ধোয়ার অথবা কলস ভরার ছল করে নদীর পাড়ে এসে মইশালদের ভাওয়াইয়া গান শুনে মুগ্ধ হয়। মাইশালরা যখন ঘরে ফিরে যেতে শুরু করে, তখন নারী হৃদয় মইশালদের আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় শোকার্ত হয়ে উঠে। তারা মইশালদের যেতে দিতে চায় না। মইশালদের উদ্দেশ্যে তারা গেয়ে উঠে-‘কোন্ দ্যাশে যান মইশাল বন্ধু মইশের পাল লইয়া ওরে আইজ ক্যানেবা মইশাল তোমরা মইশের বাতান থুইয়ারে’ ভাওয়াইয়া গানের সুরের বৈচিত্র্য হচ্ছে, এই গানের টানা সুর, তাতে শিল্পীর গলা ভাঙ্গার আশংকা থাকে। তবে চটকা গান চটুল, দ্রুত তালের এবং পরিবেশ নিতান্তই ঘরোয়া।

ভাওয়াইয়া গান সুর লালিত্যে ভরপুর এবং এর একটি নিজস্ব গীতরীতি আছে। বৈশিষ্ট্যগত কারণে সাধারণত উত্তর বাংলার শিল্পী
ছাড়া এ গানের সুর সংযোজন সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না।

ভাওয়াইয়া: যার কাছে ঋণী:

বর্তমানে আমাদের দেশে যে কয়েকজন ভাওয়াইয়া শিল্পী আছে তাদের মধ্যে একজন হলেন- শিল্পী নুরুল ইসলাম জাহিদ। ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’ গানটির জন্য তিনি বিশেষ পরিচিত হন। ভাওয়াইয়া চর্চার স্বার্থে তিনি রচনা করেছে প্রায় তিন হাজার ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গানের ভান্ডারকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা।

ভাওয়াইয়া ও আব্বাছ উদ্দিন: অবিচ্ছেদ্য যুগলবন্দী

আববাস উদ্দীন আহমদকে ভাওয়াইয়া গানের পথিকৃত বলা যায়। ভাওয়াইয়া গানকে যারা গ্রামের অভব্য শ্রেণীর গান বলে ঘৃণা করতেন তারাও গোপনে তাদের ড্রইংরুমে বসে বিমুদ্ধ হয়ে শুনতেন আববাস উদ্দীন আহমদের মধুঝরা কণ্ঠের ভাওয়াইয়া। উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালে কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি চালু হলে আব্বাসউদ্দিনের এর ভাওয়াইয়া গান শহরে ,গ্রামে, গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। মরহুম এই শিল্পীর মায়া ঝড়ানো কন্ঠের গান শুনে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার গাওয়া ‘নদীর নাম সই কচুয়া। মাছ মারে মাচুয়া মুই নারী দিছুঁ ছ্যাকাপাড়া’- এ গানের আদলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন। ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা, আখি সে নয় নাচে কালো আঁখি’ । আববাস উদ্দীন আহমদের গ্রামোফন কোম্পানিতে সর্বমোট ৩৭ খানা ভাওয়াইয়া গানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানে ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাস উদ্দীন আহমদের গাওয়া সেই ৩0 খানা ভাওয়াইয়া গানের কথা, গীতিকার, সুরকার ও রেকর্ড সাল তুলে ধরা হলো :

১ নদীর নাম সই অঞ্জনা। কথা: কাজী নজরুল ইসলাম, ৮ ডিসেম্বর ১৯৩২ খ্রি. সুর: কাজী নজরুল ইসলাম
২ কুঁচ বরণ কন্যারে তোর। কথা: আববাস উদ্দীন আহমদ
৩ গাও তোল গাও তোল কন্যারে। কথা :আব্দুল করীম ,সুর : নায়েব আলী টিপু
৪ ওকি গাড়িয়াল ভাই। কথা ও সুর: প্রচলিত,  ডিসেম্বর ১৯৩৭ খ্রি.
৫ কি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে। কথা ও সুর: প্রচলিত , ডিসেম্বর ১৯৩৭ খ্রি.
৬ কিসের মোর বাঁধন। কথা ও সুর: প্রচলিত,  ডিসেম্বর ১৯৩৮ খ্রি.
৭ আজি নদী না যাইওরে বৈদ। কথা ও সুর: প্রচলিত, ডিসেম্বর ১৯৩৮ খ্রি.
৮ বেদিয়া সোনার চাঁদ। কথা ও সুর: আব্দুল করিম, ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.
৯ ও কন্যা হস্ত কদমের ফুল। কথা ও সুর: প্রচলিত, ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.
১০ আইন বান্ধো কন্যা (দ্বৈত) কথা ও সুর: প্রচলিত
১১ বাওকুমটা বাতাস। যেমন কথা ও সুর: প্রচলিত, ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.
১২ ওরে গাড়িয়াল বন্ধুরে। কথা ও সুর: প্রচলিত, ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.
১৩ আগা নাওয়ে ডুবো ডুবো। কথা ও সুর: প্রচলিত, ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রি.
১৪ ওকি একবার আসিয়া। কথা ও সুর: প্রচলিত, জানুয়ারী ১৯৩৯ খ্রি.
১৫ ওকি পতিধন প্রাণ বাঁচে না। কথা ও সুর: প্রচলিত, মে ১৯৩৯ খ্রিঃ
১৬ আবোন ও দাড়িটা মরিয়া। কথা ও সুর: প্রচলিত, নভেম্বর ১৯৪০ খ্রিঃ
১৭ ও মোর চান্দোরো মোর সোনা। কথা ও সুর: প্রচলিত, জানুয়ারী ১৯৪১ খ্রিঃ
১৮ তুই মোর নিদয়ার কালিয়ারে। কথা ও সুর: প্রচলিত, জানুয়ারী ১৯৪১খ্রিঃ
১৯ প্রেম জানে না রসিক কালা চাঁদ। কথা ও সুর: প্রচলিত, জানুয়ারী ১৯৪১ খ্রিঃ
২০ যামো যামো যামো কন্যা হে (দ্বৈত)। কথা: আব্দুল করীম, এপ্রিল ১৯৪১ খ্রিঃ, সুর : আববাস উদ্দীন
২১ ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। কথা ও সুর: প্রচলিত, ফেব্রুয়ারী ১৯৪২ খ্রিঃ
২২ তোরষা নদীর উতাল পাতাল। কথা ও সুর: প্রচলিত, মার্চ ১৯৪২খ্রিঃ
২৩ ওরে বাবা দ্যাশের ওরে কড়ুয়া। কথা ও সুর: প্রচলিত, মার্চ ১৯৪২খ্রিঃ
২৪ মুখ কোনো তোর ডিবো ডিবো ও কথা: প্রচলিত, নভেম্বর ১৯৪২ খ্রিঃ, সুর: আব্দুল করীম কর্তৃক পরিবর্ধিত
২৫ দ্যাওয়ায় করছে ম্যাঘ ম্যাঘালি (দ্বৈত) কথা: প্রচলিত, এপ্রিল ১৯৪৬ খ্রিঃ, সুর: আব্দুল করীম
২৬ হাত ধরিয়া কঁও কথা শুন। কথা: তুলসা লাহিড়ী, জানুয়ারী ১৯৫৩ খ্রিঃ, সুর: গীরিণ চক্রবর্তী
২৭ ও মোর কালারে কালা। কথা ও সুর: প্রচলিত, জানুয়ারী ১৯৫৩খ্রিঃ
২৮ ছাড়োরে মন ভবের খ্যালা কথা: আব্দুল করীম, মার্চ ১৯৫৩ খ্রিঃ সুর: আববাস উদ্দীন
২৯ মুখ কোনা টুলোরে টুলো কথা : আব্দুল করীম , সুর: আববাস উদ্দীন
৩০ নাক ড্যাঙরার ব্যাটাটা। কথা ও সুর: প্রচলিত , জুন ১৯৫৩
প্রখিতযশা ভাওয়াইয়া গায়ক আববাস উদ্দীন আহমদের জন্ম কোচবিহার জেলার কালজানি নদীর নিকটবর্তী বলরামপুর গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ খৃস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ জাফর আলী আহমদ। মাতার নাম হীরামন নেসা। মৌলভী মোহাম্মদ জাফর আলী আহমদ অত্রাঞ্চলের জোতদার এবং একজন প্রথিত যশা আইনজীবী ছিলেন। আববাস উদ্দীন আহমদ শৈশব থেকেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ১৯২০ খৃস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তুফানগঞ্জ হাই স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে। কৃতিত্বের সাথে আই.এ পাস করার পর তিনি বিএ পড়তে আসেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তিনি এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। এরপর তিনি বিএ ভর্তি হন কোচ বিহার কলেজে। কিন্তু এখানেও বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ১৯৪৭ খৃস্টাব্দের ১৪ আগস্ট এরপর তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে।
কোচবিহারের এক অনুষ্ঠানে আববাস উদ্দীন আহমদের গান শুনে কাজী নজরুল ইসলাম বিমোহিত হয়েছিলেন। তাকে তিনি কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আববাস উদ্দীন আহমদ মাত্র ২৩ বছর বয়সে কলকাতার গ্রামোফন কোম্পানিতে দু’টি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন বিমল দাস গুপ্তের সহায়তায়। গান দু’টি সে সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। গান দুটি ছিল ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো’ এবং ‘স্মরণপারের ওগো প্রিয়’। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতায় আববাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামী গানের পাশাপাশি একাধিক ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই গানগুলো সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে । পরবর্তীতে আববাস উদ্দীনের যে গান বাজারে আসছে সেই গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন লাখো লাখো শ্রোতা। পাঁচ হাজার অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন অনেক দুর্লভ ভাওয়াইয়া গান। যার বেশিরভাগ গানে তিনি সুর সংযোজন করে গানগুলোকে সুশ্রাব্য করেছিলেন। তার ছোট ভাই আব্দুল করীমের লেখা ভাওয়াইয়া গানগুলোতেও তিনি সুরারোপ করেছিলেন। শুধু দেশে নয় লস এ্যাঞ্জেলস, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্নসহ পৃথিবীর বহু দেশে তিনি এই ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে ভাওয়াইয়া গানকে বিশ্বসভায় স্থান করে দিয়েছিলেন।

বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী:

আববাস উদ্দীন আহমদ যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন মুসলমানদের গান গাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু আববাস উদ্দীন আহমদ মুসলমান নাম নিয়েই গান গেয়েছেন এবং তাঁর বিশেষ গায়কি ঢং ও সুরেলা কণ্ঠ জয় করেছিল সে যুগের প্রতিকূল অবস্থাকে। এটি ছিল আববাস উদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আববাস উদ্দীন আহমদ ছিলেন ভাওয়াইয়া গানের জনক। তিনি হলেন ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের কিংবদন্তির ইতিহাস এবং একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে পৌঁছানোর ছিল সে সময় দু’টি পথ। তার একটি তাদের মনের কথা এদেশের ‘লোকগীতি’ অপরটি তাদের প্রাণের কথা- ‘ইসলামী গান’। আববাস উদ্দিন আহমদ অত্যন্ত ‘আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সুকৌশলে বেছে নিয়েছিলেন এ দু’টি পথ।

ভ্রান্তি:

অনেকে মনে করেন আববাস উদ্দীন আহমদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে, আসলে কথাটা ঠিক নয়। রংপুরে কখনই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেননি। ঢাকার পুরনো পল্টনে স্থায়ীভাবে আববাস উদ্দীন আহমদ বসবাস করতেন।

মৃত্যু:
ভাওয়াইয়া গানের জনক আববাস উদ্দীন আহমদ দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ ভোগের পর ১৯৫৯ খৃস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৭.৩০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর (১৯০১-১৯৫৯ খ্রিঃ)

শেষকথা:

আমাদের আত্মার সাথে সম্পর্কিত এই সংগীতের ধারাটি চর্চা , লালন, প্রসার, প্রচার ও উন্নয়নের সামগ্রিক দায়িত্ব আমাদের। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই একে ধারন ও লালনের।

তথ্যসূত্র :
১. উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া ও বিয়ের গীত। ফোক মিউজিক কাউন্সিল, ঢাকা- কাজী নাসির সম্পাদিত
২. ভাওয়াইয়া গান প্রাসঙ্গিক কথা :হাফিজুল ইসলাম জেমী
৩. ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাস উদ্দীন আহমদ :একেএম মোস্তাফিজুর রহমান
৪. বাংলা লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও বিয়ের গীত। ফোক মিউজিক কাউন্সিল, ঢাকা: ড. ওয়াকিল আহমদ
৫. লোক সাহিত্যের ইতিহাস : আশুতোষ ভট্টাচার্য


জনতা ব্যাংক ব্যবস্থাপকের অকালমৃত্যু

অগাষ্ট 2, 2016

ওয়েব কে টীম।

জনতা ব্যাংক লিমিটেড, লালবাগ শাখা, রংপুরের ব্যবস্থাপক রাশেদুর রহমান গত ০১.০৮.২০১৬ ইং সোমবার বিকেল ৪.৪৫ঘটিকায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরন করেন (ইন্নালিল্লাহে…. রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৪২ বছর। তিনি মা, স্ত্রী ও দুই কন্যা রেখে যান।

প্রয়াত রাশেদুর রহমান রুমন কালীগঞ্জ উপজেলার কাশীরাম গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। জনতা ব্যাংকে অফিসার হিসাবে যোগদান করেন ১৯৯৮সালে। শ্যামপুর, আলমনগর শাখায় সফলভাবে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনের পর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং শাখা ব্যবস্থাপক হিসাবে লালবাগ শাখায় যোগদান করেন। এ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্থায় বিগত ০১ আগষ্ট বিকেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাৎক্ষনিক রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা জনতা পরিবারে। ঐদিন রাতে রংপুরের বাসায় জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার গ্রামের বাড়ী কামিরামে। আজ সকাল ১১.০০ টায় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

কর্মঠ, সদালাপী, প্রানবন্ত এই মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জনতা ব্যাংক লিমিটেড, বিভাগীয় কার্যালয়ের ইনচার্জ মো: আখতারুজ্জামান, উপমহাব্যবস্থাপক, এরিয়া অফিস রংপুরের উপমহাব্যবস্থাপক কাজী খলিলুর রহমান সহ ব্যাংকের অন্যান্য নির্বাহীগন, তার রংপুর ও কুড়িগ্রাম এরিয়ার সহকর্মীবৃন্দ সহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় শরীক হন।

রাশেদুর রহমানের অকাল মৃত্যতে ওয়েব কে টীম তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছে এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।


লালমনিরহাট জেলার ভাষা সৈনিক

অগাষ্ট 2, 2016

লালমনিরহাটের ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ কোন তালিকা সংরক্ষিত নেই। সেভাবে তালিকাও হয়নি। তবে পত্রপত্রিকা, ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, জেলা প্রশাসন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃক প্রদত্ত ভাষাসৈনিককে সংবর্ধনা প্রদান এসব তথ্যের আলোকে জীবিত ও প্রয়াত নারী-পুরুষ মিলে ১২ জন ভাষাসৈনিকের তথ্য পাওয়া যায়। এদের মধ্যে  জীবিত রয়েছেন পাঁচজন।

ভাষাসৈনিক শামছুল হক : ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। লালমনিরহাটে গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। সেই সময় ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে তিনি এবং ভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্য লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে লালমনিরহাট থানা পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করতে স্কুলের গেটে অবস্থান নেয়। তবে প্রধান শিক্ষক পুলিশকে স্কুলে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় তিনি গ্রেফতারের হাত থেকে রেহাই পান।

ভাষাসৈনিক সিরাজুল ইসলাম : নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যের বাজার এলাকার বিন্নিপাড়া গ্রামে ১৮৯৯ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। ’৫০-এর দিকে বর্তমান লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার দুরারকুটি (বালাপুকুর) গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি স্থানীয় ছাত্রনেতাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের দিন তিনি ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হন। শহরের প্রবেশ মুখে পুলিশ মিছিলটিতে লাঠি চার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিলেও তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন করে।

ভাষাসৈনিক আবদুল কাদের ভাসানী : ’৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চবিদ্যালয় দশম শ্রেণীতে অধ্যায়নের সময় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাটের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসবর্জন করার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে শিক্ষার্থীরা সাড়া দিয়ে বাড়িতে চলে যায়। তিনি পুলিশের খাতায় একজন পাকিস্তানবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হন। সেই দিন স্কুলের পেছনের প্রাচীর টপকে পালিয়ে গ্রেফতার এড়ান। পরে পুলিশ তাঁকে আটক করে।

ভাষাসৈনিক মহেন্দ্র নাথ রায় : ১৯৫০ সালে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার আরএমপি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট  অর্জন করেন। পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যায়নের সময় আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠনের সময় ও ১৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে ছাত্র নেতাদের গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় রংপুরে ফিরে আসেন। ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করার খবর পেয়ে তাঁর নেতৃত্বে রংপুরে ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রংপুর ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল চত্বরে প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেন। পুলিশ সেই সভায় লাঠি চার্জ করেএবং সভাস্থল খেকে তাঁকে সহ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করে।

ভাষাসৈনিক জহির উদ্দিন আহম্মেদ : ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে অধ্যায়ন করার সময় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি লালমনিরহাটে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হলে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২৩ ফেব্রুযারি হরতালের সমর্থনে স্কুলের ছাত্রদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেন। তিনি কৌশলে পালিয়ে গেলেও পরে পুলিশ ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করে।

[সৌজন্য: জনকন্ঠ]


বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়নে বাংলাদেশ অনুকরনীয়

অগাষ্ট 1, 2016

ছিটমহলবাসীর পক্ষে কথা বলায় ছাড়তে হয়েছিল রাজনৈতিক দলের পদ। ছেড়েছেন রাজ্য সরকারের বিধায়কের পদও। সব ছেড়ে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আন্দোলন করার সময় ২০০৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা যাওয়ার আগে বিনিময় আন্দোলনের দায়িত্ব ছেলের হাতে দেন দীপক সেন। এরপর ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্তও নেমে পড়েন ছিটমহলবাসীর মুক্তির আন্দোলনে। ভারতের দিনহাটায় থাকা ছিটমহল আন্দোলনের অন্যতম এই নেতার সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে কথা বলেছেন কালের কন্ঠের লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবু।

 

ছিটমহলবাসীর পক্ষে কথা বলায় ছাড়তে হয়েছিল রাজনৈতিক দলের পদ। ছেড়েছেন রাজ্য সরকারের বিধায়কের পদও। সব ছেড়ে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আন্দোলন করার সময় ২০০৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা যাওয়ার আগে বিনিময় আন্দোলনের দায়িত্ব ছেলের হাতে দেন দীপক সেন। এরপর ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্তও নেমে পড়েন ছিটমহলবাসীর মুক্তির আন্দোলনে। ভারতের দিনহাটায় থাকা ছিটমহল আন্দোলনের অন্যতম এই নেতার সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে কথা বলেছেন লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবুকালের কণ্ঠ : ছিটমহল বিনিময়ের পর আপনারা ঘোষণা করেছিলেন, প্রতিবছর ১ আগস্ট ছিটমহলের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করবেন। ঠিক সেই ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি, স্থানীয় বাসিন্দারা করছেন আনন্দ-উল্লাস। কিন্তু এর একেবারে উল্টোচিত্র হিসেবে প্রথম বর্ষপূর্তি পালনের বদলে কেন অন্ধকার দিবস পালন করা হচ্ছে ভারতের বিলুপ্ত ছিটমহলে?

দীপ্তিমান সেনগুপ্ত : ছিটমহলগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সাবেক বাংলাদেশি ছিটের বাসিন্দারা এখনো এর কোনো সুফল পায়নি। বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু গত এক বছরে ভারতে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এখন পর্যন্ত এখানকার সরকার বঞ্চিত মানুষগুলোকে জমির কাগজই দিতে পারেনি। হয়নি পানীয়জলের ব্যবস্থা, তৈরি হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা রাস্তাঘাট। সমাজকল্যাণ দপ্তরও করেনি কিছু। কারো সরকারি চাকরিও হয়নি। তাই প্রতিবাদ হিসেবে আমরা দিনটিকে অন্ধকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছি।

কালের কণ্ঠ : ছিটমহলের উন্নয়নে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের প্রাথমিক বরাদ্দ তো অনেক বেশি ছিল। এর পরও কেন এ অবস্থা?

দীপ্তিমান : ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়া সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহল এবং বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে চলে আসা হাজারখানেক মানুষের জন্য ভারতীয় সরকার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমাদের হিসাবে এখন পর্যন্ত বড়জোর পৌনে চার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে চলে আসা ২০১টি পরিবারের জন্য টিনের খুপড়ি ঘর তৈরি করতেই নাকি খরচ হয়ে গেছে ১৭ কোটি টাকা। এর পরও এক বছর আগে যা ছিল এখনো সেই অবস্থায় আছে সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলো।

কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে চলে গেছে তাদের কী অবস্থা?

দীপ্তিমান : তাদের অবস্থা আরো কঠিন। তারা আরো বেশি খারাপ অবস্থায় আছে।

কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলবাসীর উন্নয়ন নিয়ে কী বলবেন?

দীপ্তিমান : বাংলাদেশে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। রাস্তাঘাট হচ্ছে, পানীয়জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে এবং ঈদের সময় অভাবী মানুষকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অনেক আগেই ভূমি জরিপের কাগজ সেখানকার বাসিন্দাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষই করে ফেলেছে।

কালের কণ্ঠ : তাহলে বলতে গেলে ছিটমহল নিয়ে এখনো আপনাদের আন্দোলন শেষ হয়নি। সেটা অব্যাহত থাকবে?

দীপ্তিমান : অব্যাহত থাকবে মানে বাঁচার তাগিদেই সেই আন্দোলন চলবে।

কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে গত এক বছরে ছিটমহলের উন্নয়ন নিয়ে কী বলবেন?

দীপ্তিমান : বাংলাদেশ সরকার যে উন্নয়নটা করছে তা একেবারে মানুষের দাবি সামনে রেখেই। এটাই হচ্ছে সহানুভূতিশীলতার বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের ১৯৭১-এর যে অভিজ্ঞতা তা কাজে লাগাতে পেরেছে বলেই বাংলাদেশ এত দ্রুত সব করতে পারল বলে আমি মনে করি। বিলুপ্ত ছিটমহলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই উন্নয়নকেই অনুসরণ করা উচিত ভারতের।

[courtesy: Kaler Kantho]